ছাত্র জীবনে আমি পড়াশোনায় এম. এস. (যার থিসিস সেই ২০১০ থেকে এখন পর্যন্ত চলছে ) এর আগ পর্যন্ত কখনই মনোযোগী ছিলামনা । ইন্টারেস্ট ( কদাচিত ) না পেলে খাটাখাটনি করে পড়াশোনা করার অভ্যাসটা আমার কখনই গড়ে ওঠেনি । তাই ক্লাস সেভেন এর পর থেকে আমি ক্লাস এর একেবারে শেষের দিকের ছাত্র হয়ে যাই । ক্লাস এইট এ এসে আমাকে সেই উদাসীনতার শাস্তি পেতে হলো। ১৯৯৫ সনে ঢাকা গভট. ল্যাবরেটরি স্কুল এর হেড স্যার আর আমার বাবা মা এর মিলিত সিদ্ধান্তে আমাকে দ্বিতীয় বার ক্লাস এইট এ পড়তে হলো । এর আগের বছর অর্থাত ১৯৯৪ সনে , সম্ভবত অগাস্ট মাসে আমি ওই স্কুল এ ক্লাস এইট এ ভর্তি হই। আমার বাবা তখন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এ কর্মরত এবং স্কুল এর গভের্নিং বডি এর চিফ। তার সিদ্ধান্তে আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এর সাথে আমার পছন্দের ডে শিফ্ট এ ভর্তি না হয়ে হলাম মর্নিং শিফট এ । যাইহোক , এই সব এবং আরো কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ( এবং আমার কাছে সারপ্রাইজিং) ঘটনার সূত্র ধরে ১৯৯৫ সন থেকে শুরু হলো ব্যাচ '৯৮ নামক অদ্ভুত এক ব্যাচ এর কিম্ভুত মর্নিং শিফট এর সাথে আমার এক দুঃসহ যাত্রা । ছেলে পেলে গুলোর মাচুইরিটি বলতে কিছু নেই , সবগুলোই ফ্যান্টাসি ওরিয়েন্টেড , যেগুলা আঁতেল সেগুলো একেবারে অসহ্য রকমের আঁতেল , যেগুলো একটু দামড়া তারা নিয়মিত বুলিয়িং করে যাচ্ছে। একই ক্লাস এ বিভিন্ন গ্রুপ , একটা আরেকটার সাথে কখনই মেশে না। এমনকি একই গ্রুপ এর বন্ধুদের মধ্যেও দেখলাম পড়াশোনা নিয়ে সুপ্ত প্রতিহিংসা । মানে একেবারে বাচ্চাদের মতো । ওই পুরো ক্লাস এর আলোচনার টপিকস হলো , ভিডিও গেমস , ডব্লিউ ডব্লিউ এফ এর রেসলিং, ব্যান্ডের গান , কে হকিংস এর ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম পরেছে কে পরে নাই , পাকিস্তান আর ইন্ডিয়া এর ক্রিকেট , ..( যেগুলো উল্লেখ করার মত ) . এদের ইম্যাচুইরিটি এর একটা অদ্ভুত লক্ষণ হলো এরা একজন আরেকজন এর মতামত খুব সহজে গ্রহণ করে না। নিজে কিছু জানুক না জানুক , বুঝুক না বুঝুক নিজের ইগো কে সাড়ম্বরে প্রকাশ করতে এরা মোটেও দ্বিধা করে না। " কে বলসে !!?", " তুমি বেশি জানো !!? " , " চাপা কম মারো " ," তুমি কবে থেকে এইটা দেখো !!? ", " আমিতো তো জন্মের পর থেকে দেখছি " , "তুমি চুপ থাক মিয়াহ" এগুলো ছিল তাদের কমন ডায়ালগ । বাবার সরকারী চাকরির সুবাদে আমি বাংলাদেশ এর বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন স্কুল এ পরেছি। আর কোথাও পড়াশোনার বাইরে এতটা ফ্যান্টাসি এফোর্ড করতে পারা ছেলে পেলে দেখিনি। যাই হোক পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়াবো মনে করে আমার ফ্যান্টাসি , আমার প্যাশন , আমার নেশা বি. এন. সি. সি. ১৯৯৩ এ শুরু করার পর ১৯৯৪ এ পুরো এক বছর দুরে ছিলাম। ১৯৯৫ সনে হতাশা কাটাতে আর উজ্জীবিত হতে আমি গভট. ল্যাবরেটরি এর মর্নিং শিফট প্লাটুন এ যোগ দেই। সেখানেও দেখলাম খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি । আমি ভাবলাম কি বেপার রে ভাই এই প্লাটুনের ক্যাডেট রা তো ড্রিল শুরু হবার আগে পাহাড়ি রাস্তায় দুই মাইল দৌরয় না । এরা তো ভোর ছটায় এসে ফলিন হয় না। তবে এরা বেশ স্মার্ট । এই বি. এন. সি. সি. এর সুবাদে আমি মিশতে থাকি ডে শিফট এর ছেলেদের সাথে । এরা একেবারেই অন্য রকম । কোনো আলগা ঢং , নেকামি মার্কা তুমি তুমি নেই , ডাইরেক্ট তুই তুই , যা বলবে মুখের উপরে , বন্ধুকে প্রাণ খুলে ভালো বাসবে । সে পড়াশোনায় কতটা পিছিয়ে বা এগিয়ে তারা এটার মোটেও কেয়ার করে না । এমনকি মর্নিং শিফট এর একজন ক্যাডেট এর ভালো পারফরমেন্স এ এদের কারো কারো মনে যে বিরক্তি বা প্রতিহিংসার সৃস্টি হয়েছিল , তাও এরা খুব একটা লুকিয়ে রাখত না। এদেরকে পেয়ে আমি যেন একবছর পর আর কাঁচা বয়সে অনেক বড় একটা মানসিক ধাক্কা পাবার পর , স্কুল জীবনের মজা আবারও কিছুটা ফিরে পেলাম । যাই হোক এতসব বলার উদ্দেশ্য হলো যাদেরকে নিয়ে এখন কথা বলবো তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড টা একটু তুলে ধরা। দেশীয় পণ্য ব্যবহারে যে দেশের উন্নতি আর এটা যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দেশপ্রেম এর চেতনার সব চাইতে এফেক্টিভ প্রয়োগ , এই কথাটা আমার বাবা আমাকে ভালো ভাবেই বুঝিয়েছিলেন । আরো বুঝেছিলাম যে ভারত বাংলাদেশ কে তাদের পন্যের একটা একচেটিয়া বাজার এ পরিনত করতে চায়। জী !!, অবাক করার মত শোনালেও এটাই সত্তি যে একেবারে বাচ্চা বয়স থেকে জ্ঞান হবার পর থেকে এই জন্মভূমি বাংলাদেশ কে অসম্ভব ভালবাসতাম , মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্বিত অনুভব করতাম , দেশের উন্নতির চিন্তা করতে করতে সেই চত বয়সেই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম। বিকেলে বন্ধুদের সাথে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা ছিল আমার খুবই প্রিয়। এমনি এমনি আমাকে 'মিম পাগলা' বলা হত না । এস. এস. সি. পরীক্ষা এর জন্যে আমি এক প্যাকেট ইকোনো ডি এক্স বল পয়েন্ট দিয়ে আর এইচ.এস. সি. তে ব্যবহার করেছি অলিম্পিক ফাইন (মেটাডোর কোম্পানি টা আসলে ইন্ডিয়ান)। পড়াশোনার ব্যাপারে উদাসীন থাকলেও এই ব্যাপার গুলো নিয়ে আমি কখনই কম্প্রমাইজ করতাম না। এমনকি আমার বাসায় কখনো প্যারাশুট নারিকেল তেল আনা হলে আমি চেঁচামেচি শুরু করে দিতাম জুই বা হাস মার্কা তেল কেন আনা হলো না । ক্লাস নাইন এ ওঠার পর ছেলেদের মাঝে হাই নেক ব্লাক বুট পরার একটা ফেশন শুরু হলো। আমি আমারটা কিনতে গিয়ে এক দোকানদার ইন্ডিয়ান সোল বলার পর সেখানে এক নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে বাংলাদেশী সোল বলা হাই নেক নিয়ে ফিরে আসলাম। এতে যে একেবারেই কাজ হতো না তা না। আমার পরিবারের লোকজন অন্তত আমার জন্যে কখনই কোনো ভারতীয় পণ্য আনতেন না । বাসায় ভারতীয় পণ্য একেবারে না পারতে ছাড়া ব্যবহার করতেন না । এই ব্যাপারটাই আমাকে অনেক সান্তনা দিত । আর আজ এখন এমন এমন সব মানুষদের কাছ থেকে আমাকে দেশ প্রেম এর বক্তৃতা শুনতে হয় যাদের অনেকের দেশ এর অভিজ্ঞতা হলো এই ঢাকা শহর , দেশপ্রেম আর মুক্তি যুদ্ধের চেতনা হলো , ওই কমিউনিস্ট ,এন্টী ইসলামিক একটিভিস্ট, জনসমর্থনহীন , সুযোগ সন্ধানী গণজাগরণ মঞ্চে গিয়ে একটু 'তুই রাজাকার , তুই রাজাকার বলে ' চিল্লাচিল্লি করা।
No comments:
Post a Comment